আমরা সবাই জানি, বিগত কয়েক দশক যাবৎ সরলমনা সাধারণ মানুষ, যারা ধর্মীয় জ্ঞানে অনগ্রসর, তাদেরকে তাকলীদ ও মাযহাব ত্যাগ করে ‘লা-মাযহাবী’ পন্থায় কোরআন-হাদীস অনুসরণের জোরদার আহ্বান জানানো হচ্ছে। যা মুসলমানদের মাঝে নতুন একটা ফেতনা ও বিশৃংখলার জন্ম দিয়েছে এবং ক্রমেই তা পারস্পরিক অনাস্থা-অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি করে চরম ধর্ম-সামাজিক অরাজকতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে! গ্রামে-গঞ্জে পাড়ায়-মহল্লায়, এমনকি মসজিদে মসজিদে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের ঝড় উঠছে। একপেশে মনোভাবের কিছু লোক এই বলে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে যে, ‘মাযহাব মানা হারাম বরং শিরক! মাযহাবের অনুসারী সকল মুসলমান বিদআতী, কাফের ও মুশরিক!’
দ্বীনী দাওয়াত ও ইলমী বিতর্কের আদব-কায়দার তোয়াক্কা না করে বিদ্বেষপূর্ণ একপেশে বক্তব্য সম্বলিত পুস্তিকা বিতরণ, লিফলেটবাজি, টেলিভিশন প্রোগ্রাম, ইন্টারনেট আপলোডিং ইত্যাদি কারণে মুসলিম সমাজে আন্তরিকতাপূর্ণ সহ-অবস্থানের পরিবর্তে সর্বত্র ঘৃণা-বিদ্বেষের বিষ-বাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে এবং এমন একটি অল্পবিদ্য সংক্ষুব্ধ শ্রেণীর উদ্ভব ঘটছে, যারা উগ্র এবং অসহিষ্ণু। যারা আগের-পরের দেশের-বিদেশের অধিকাংশ মুসলিম জনসাধারণ ও আলেম-উলামাকে পথভ্রষ্ট, বিদআতী এমনকি কাফের-মুশরিক বলতে মোটেও দ্বিধা করে না। পূর্বসূরীগণের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং মুসলিম সমাজের অংশ হয়েও অধিকাংশ মুসলিমের প্রতি কল্যাণকামিতার পরিবর্তে আক্রমণাত্মক কর্মধারা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ অবলম্বন করে দিন দিন যারা প্রাচীনকালের খারেজী সম্প্রদায়ের রূপ পরিগ্রহ করছে। বিশ্বের প্রায় সকল মুসলমান হাজার বছর ধরে যে চার ধারার আলেমগণের সুবিন্যস্ত ব্যাখ্যানীতি (মাযহাব) মোতাবেক কোরআন-সুন্নাহর উপর আমল করে আসছে, সেই চার মাযহাবকে অন্যায়ভাবে সম্পূর্ণ বাতিল আখ্যা দেয়ার কারণে ক্রমেই মুসলিম সমাজ এক ভীষণ অন্তর্ঘাতী সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যা মুসলিম-বিশ্বের জন্য ভয়ংকর এক অশনি সংকেত। এ জন্য আলেম-উলামা তো বটেই, প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ এবং অভিভাবক শ্রেণীর সাধারণ মানুষও অত্যন্ত দুঃখিত ও চিন্তিত।
এমতাবস্থায় মাযহাব-প্রসঙ্গসহ এ-জাতীয় চিরাচরিত বিষয়সমুহ যাতে সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতে পারে এবং বিভ্রান্তি থেকে বাঁচতে পারে তার জন্য আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত জরুরি। তাহলে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ, যাদের নিয়ত ভালো এবং যারা ইনসাফ পসন্দ করে, তারা ইনশাআল্লাহ বিভ্রান্তি থেকে বেঁচে যাবে। মাযহাব-প্রসঙ্গে বক্ষমাণ পুস্তিকা একটি সহজ-সরল উপাস্থাপনা। আশা করি এটি সাধারণ পাঠকের উপকারে আসবে।
মূল কিতাব হলো ভারতের প্রখ্যাত আলেম হযরত মাওলানা মুহাম্মদ মনযূর নুমানী রহ.-এর দৌহিত্র মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া নুমানীর একটি ওজস্বী কিতাব ‘তাকলীদ আওর মাযহাবী এখতেলাফ কী হাকীকত’(মাযহাব ও ইমামগণের ইখতিলাফের মূল রহস্য)-এর সারসংক্ষেপ। মাওলানা নিজেই নিজের এই কিতাবের সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করেছেন এবং নাম দিয়েছেন ‘তাকলীদ পর গওর কারনে কা সীধা রা-স্তাহ’(মাযহাব বুঝার সরল পথ)। উভয় কিতাব সকলের সংগ্রহে রাখার মতো। প্রথমোক্ত কিতাবে চারটি মৌলিক বিষয় দালিলিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে,
১. মহামতি ইমামগণের ইখতেলাফের (মতপার্থক্যের) যৌক্তিক কারণসমূহের একটি কারণ কোরআন-হাদীস নিজেই। অর্থাৎ কোরআন-হাদীসের দলিলের মাঝেই একাধিক মতের অবকাশ নিহিত। ফলে ঐ একাধিক মতের একটিকে হক বলে অন্যটিকে বাতিল আখ্যা দেয়ার সুযোগ নেই। বরং শুধু এতটুকু যে, বিভিন্ন বিবেচনায় একটি কারো কাছে প্রাধান্যযোগ্য, আরেকজনের কাছে অন্যটি। সুতরাং এ জাতীয় ক্ষেত্রে নিজের মতকেই শুধু সঠিক বলা এবং অন্যমতকে সম্পূর্ণ ভুল আখ্যায়িত করা অন্ধ আবেগ আর মূর্খতা ছাড়া কিছুই নয়।
২. ইখতেলাফী মাসআলার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জন্য মাযহাব মানাই (দলিল-নির্ভর মতপার্থক্যপূর্ণ মাসআলায় নির্দিষ্ট ইমামের ব্যাখ্যা মেনে চলাই) দ্বীনের উপর আমল করার স্বভাবসিদ্ধ পদ্ধতি। এ ছাড়া গত্যন্তর নেই।
৩. উপরোক্ত কারণে সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত সমগ্র মুসলিমবিশ্ব বিশেষ বিশেষ মাযহাবের ব্যাখ্যা মোতাবেক কোরআন-সুন্নাহের উপর আমল করে আসছে।
৪. উম্মতের গ্রহণযোগ্য প্রায় সমস্ত আলেম ও মুহাদ্দিস চার মাযহাবের কোনো না কোনো মাযহাব মোতাবেক দ্বীনের উপর আমল করে গেছেন।
পুস্তিকার শেষে সম্পাদকের তরফ থেকে একটি পরিশিষ্ট যোগ করা হয়েছে। মাকতাবাতুল আযহার থেকে পুস্তিকার তৃতীয় সংস্করণ প্রচারিত হচ্ছে। আল্লাহ পাক সংশ্লিষ্ট সকলকে উত্তম জাযা দান করুন, আমীন।